মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:১৫ পূর্বাহ্ন

ফরিদপুরে দুর্গম চরাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী কৃষকরা

তোফায়েল হোসেন
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৫
  • ৮ বার পঠিত

বাংলাদেশের চরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন সব সময়ই চ্যালেঞ্জপূর্ণ। বালুময় মাটির কারণে জমিতে বারবার পানি সেচ দিতে হয়, উৎপাদন বাড়াতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। ফলে কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়ে। তবে ফরিদপুরের ডিগ্রির চরে ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেছে। এখানকার কৃষকরা রাসায়নিক সার ছাড়াই নানা ধরনের সবজি চাষ করে নিজেদের জীবনমান উন্নত করেছেন। ডিগ্রির চরে বর্তমানে মিষ্টি কুমড়া, আলু, গাজর, পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। রাসায়নিক সার পরিহার করে জৈব সার ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত কৃষকরা এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী। কৃষকদের জীবনযাত্রার এই ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা “আমরা কাজ করি” (একেকে)। তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে “পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন” (পিকেএসএফ)। |

একেকে-এর সহযোগিতায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন চরটির বাসিন্দা রাহেলা বেগম। তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে জানান, আগে তারা রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ভুট্টা, ধান ও গম উৎপাদন করতেন, তবে এতে বছরের অর্ধেক সময় জমি পতিত রাখতে হতো। এখন একেকে-এর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা বছরজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন এবং জমিতে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন না।

একেকে-এর সহযোগিতায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন চরটির বাসিন্দা রাহেলা বেগম। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে তারা ভূট্টা, ধান, গমের মতো ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক সার ব্যবহার করতেন। ফলে বছরের অর্ধেক সময় জমি পতিত রাখতে হতো। তবে বর্তমানে একেকে-এর সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছেন। এখন তারা জমিতে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না।

রাহেলা বেগম বলেন, “আগে আমাদের জমি বছরের অনেকটা সময় ফাঁকা পড়ে থাকত। কিন্তু এখন একেকে-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে এক জমিতে বিভিন্ন ফসল চাষ করছি। জৈব সার ব্যবহারের ফলে আমাদের ফসলের বাজারমূল্যও বেশি।”

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাহেলা বেগমের বাড়ির পাশের ১ বিঘা জমিতে “চরাঞ্চলে অ্যাগ্রো ইকোলজিক্যাল ফার্মিং পদ্ধতিতে মিশ্র ও আন্তঃফসল চাষের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ” প্রকল্পের আওতায় জৈব সার ব্যবহার করে বাঁধাকপি, গাজর ও মিষ্টি কুমড়া চাষ করা হচ্ছে। জমির চারপাশে বেড়াগাছ হিসেবে ধনিয়া চাষ করা হয়েছে, যা বাড়তি আয়েও সহায়তা করছে।

রাহেলা বেগম আরও বলেন, “এখন বেশি ফসল উৎপাদন হচ্ছে, ফলে লাভও বেশি হচ্ছে। আগের তুলনায় আমরা আর্থিকভাবে অনেকটাই স্বাবলম্বী। সংসারে অভাব-অনটন নেই বললেই চলে।”

জানা গেছে, কৃষকদের স্বাবলম্বী করতে ২০২৪ সালে ডিগ্রির চরের প্রায় ৭২২ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে একেকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪৫ জন কৃষকের জমিতে জৈব সার ব্যবহার করে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের প্রদর্শনী চালু করা হয়েছে। এছাড়া ২০ জন কৃষককে ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন এবং একজনকে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। বাকি কৃষকদের আর্থিক সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।

একেকে-এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ডিসেম্বরে ডিগ্রির চরের মো. দেলোয়ার হোসেন খাঁকে   ক্ষুদ্র পরিসরে সোলার প্যানেল দ্বারা কৃষি জমিতে সেচ প্রকল্প প্রদানের জন্য ১২০০ ওয়ার্ড এর ২ টি সৌর প্যানেল, ১ হর্স পাওয়ার সাবমাসিবল পাম্প সেট প্রদান করা হয়। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো- পরিবেশবান্ধব উপায়ে জমিতে সেচ প্রদান, সবজি উৎপাদন ব্যয় কমানো, বসতভিটায় বারো মাস নিরাপদ সবজি উৎপাদন, পারিবারিক বিশুদ্ধ পানির জোগান, চরাঞ্চলে সোলার প্যানেল এর সংখ্যা বৃদ্ধি বা উদ্যেগতা তৈরি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনি প্রায় ৩ বিঘা জমিতে– বাঁধাকপি,ফুলকপি, মুলা, পুঁইশাক, মিষ্টিআলু, লালশাক, বেগুন, টমেটো, রেড ক্যাবেজ, রঙিন ফুলকপি, গাজর, পেঁয়াজ, বেড়া ফসল হিসেবে ধনিয়া, কুমুম ফুল চাষ করেছেন । এই সবগুলো ফসলের চাষাবাদে সেচ কাজ তিনি সোলার প্যানেল পাম্প দ্বারা সম্পন্ন করছেন।

বর্তমানে প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে বিকেল ৫ পর্যন্ত জমিতে সেচ প্রদান করছেন দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, “পাইলটিং প্রদর্শনীর ফলে আমার কৃষি ও পারিবারিক জীবনে অনেক সময় ও আর্থিক লাভ হচ্ছে । আগে জমিতে সেচ প্রদান করার জন্য শ্রমিক নিতে হতো। প্রতি সপ্তাহে সেচ এর জন্য তেল লাগতো প্রায় ১০ লিটার। কিন্তু এখন কোনো শ্রমিক লাগে না, তেল লাগে না। সম্পন্ন বিনা খরচে আমরা জমিতে সেচ দিতে পারছি।”

তিনি আরও বলেন, “পাইপ দিয়ে জমিতে যতটুকু সেচ প্রয়োজন হয় আমি ততটুকুই দিতে পারি। শুধু সুইচ অন করলেই হয়। আমার বাড়ির দৈনন্দিন কাজের পানি যেমন- রান্না, গবাদি পশু লালন পালনসহ এদের গোসল, পারিবারিক পানির চাহিদা এই সেচ প্রকল্প হতে পূরণ হচ্ছে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে।”

একেকের প্রজেক্ট এর কোঅডিনেটর মো. ফুয়াদ হোসেন বলেন, “আমরা কৃষকদের ট্রেনিং দিয়েছি। তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করছি। উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত তাদের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও তারা যাতে অনলাইনে তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে পারে সেই জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।”

একেকে নির্বাহী পরিচালক এম.এ জলিল বলেন, “আমরা পিকেএসএফ এর সহায়তায় প্রাথমিকভাবে ডিগ্রিরচর ইউনিয়ন এ ১টি ক্ষুদ্র পরিসরে সোলার প্যানেল দ্বারা কৃষি জমিতে সেচ কার্যক্রম এর পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, যা সফলতা পেয়েছে এবং অনেক কৃষক আগ্রহ প্রদান করছে। ভবিষ্যৎ এ আমরা এই চরে এর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য পিকেএসএফ সহ অন্যান্য ডোনার কে প্রস্তাবনা প্রেরণ করবো। আমি দাঁতা সংস্থা  ইফাদসহ পিকেএসএফ কে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রদান করছি।”

পিকেএসএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আকন্দ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা কৃষকদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছি। আমাদের এই কার্যক্রম ভবিষ্যতে চলমান থাকবে।”

ফরিদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহাদুজ্জামান বলেন, “নবায়ন যোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এর   জন্য সোলার  একটি  আদর্শ পদ্ধতি। বিশ্বের অনেক অনেক দেশে এটি বান্যিজিক ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে । চরাঞ্চলে  পরিবহণ এর জন্য জ্বালানি  তেলের দাম বেশী, এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেশি হয়ে থাকে । আমি আশা করবো পিকেএসএফ ও একেকে এটি আরো  অন্যান্য চরাঞ্চলে সম্প্রসারণ করবে ।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 gangnisongbad.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com
ThemesBazar-Jowfhowo