“খাওয়া দূরের কথা, কোরবানি ঈদের পর থেকে মাংস চোখে দেখিনি!” ভিক্ষা করতে এসে এসব কষ্টের কথা জানালেন নকিনা বেওয়া। নকিনা বেওয়া মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের চেংগাড়া গ্রামের মৃত ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী।
বর্তমানে স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে জিন্নাতি ও নাতনি মনিরাকে নিয়ে নকিনা বেওয়ার সংসার। তিন ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানের জননী হয়েও ছেলে-মেয়েদের সংসারে ঠাঁই হয়নি অসুস্থ নকিনা বেওয়ার। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য অসুস্থ নকিনা বেওয়াকে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষা করতে হয়। সারাদিন ভিক্ষা করে কোনদিন ২০০ আবার কোনদিন ৩০০ টাকা উপার্জন হয়। তা দিয়ে প্রতিদিন তিন জনের খাবারের জোগান সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারপরেও রয়েছে হাঁপানি রোগের ওষুধ কেনার চাপ।
প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় ভাত অথবা রুটির সাথে থাকে শাকপাতা, আলু ও ডাল। এর বাইরেও যে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার রয়েছে সামর্থের অভাবে সেটা একেবারেই অচেনা রয়ে যাচ্ছে। ইতোপূর্বে সপ্তাহে একবার মাছের দেখা মিললেও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তার ধারে কাছে যাওয়া হয়নি যে কতদিন তা মনে পড়েনা। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি মাছের দাম ২০০ টাকার উপরে আর গরুর মাংস প্রতি কেজি ৮শ’টাকা।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি বিষয়ে ক্রেতা সাঈদ হাসান জানান, শুধু হত দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের নয়, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি প্রভাব ফেলেছে মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণীর মানুষের উপর। আয়-উপার্জন না বাড়লেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি রেখে চলা খুবই মুশকিল হয়ে পড়েছে। কয়েক মাস আগে ৫ সদস্যের সংসারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ৩৫ আইটেমের জিনিস কিনতে খরচ হতো তিন হাজার টাকা। একই পণ্য কিনে সেখানে বর্তমানে গুনতে হচ্ছে ছয় হাজার টাকা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে হুড়হুড় করে বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম।
এই সুযোগে অধিক লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দ্রব্য আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ফলে দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি জোরদারের দাবি জানিয়েছে তিনি ও ক্রেতা সাধারণ। কয়েকজন ক্রেতার সাথে কথা বলে দেখা যায়, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে।
মুদী ব্যবসায়ী এনামুল হক জানান, ৫-৬ মাস আগে চিনি বিক্রি করেছি ৫০-৬০ টাকা, বর্তমানে ওই চিনি ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এক কেজি জিরা বিক্রি করেছি ৩৫০-৪০০ টাকায় ওই একই জিরা বর্তমানে বিক্রি করতে হচ্ছে ৭০০ টাকায়। তিনি আরো জানান, বেশি দরে দ্রব্য কিনতে হচ্ছে তাই বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। একই কথা জানিয়েছেন মুদি ও স্টেশনারি ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম।
মুরগি ব্যবসায়ী রহিদুল ইসলাম জানান, সোনালি মুরগি ২-৩ মাস আগে ২১০ টাকায় বিক্রি করেছি বর্তমানে সোনালি মুরগির দাম ৩২০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৬০ থেকে ২৭০ টাকা, লেয়ার মুরগি ২৫০ থেকে ৩২০ টাকা, দেশি মুরগি ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা, পাতিহাঁস প্রতি পিস ছিল ৩০০ টাকা বর্তমানে ৩০০ টাকা কেজি এবং রাজহাঁস ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুরের গাংনী এলাকার সিটি ‘বি’ গ্রুপ ডিলার আরিফুল ইসলাম দ্রব্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ক্ষেত্রেই খরচ বেড়ে গেছে। ফলে চিনি ছয় মাস আগে বিক্রি করেছি ৮০ টাকায় সেই চিনি বর্তমানে ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। ভোজ্য তেল ১৫০ থেকে ১৮৩ টাকা, আটা ৪০ থেকে ৬১ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মেহেরপুর জেলার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও শিক্ষা অনুরাগী সিরাজুল ইসলাম মাস্টার জানান, শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নয়, দাম বেড়েছে সবকিছুতে এমনকি বিশ্ব অর্থনীতি এর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলসহ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি নানা কারণে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতি যাই হোক না কেন বাংলাদেশ যাতে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
তাছাড়া মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়ার মিরপুর পর্যন্ত পাকা সড়ক প্রশস্তকরণ কাজের জন্য রাস্তার দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ফলে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সরকারি উদ্যোগে তাদেরকেও পুনর্বাসন করার দাবি উত্থাপন করেন তিনি।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মনসুর আলম খান জানান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে। তবে যদি ক্রেতারা বেশি দামে পণ্য ক্রয় করে আনে সেক্ষেত্রে তো বেশি দামে বিক্রি করবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে যদি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তাছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) থেকে কার্ডধারীদের মাঝে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে। আসন্ন রমজানকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা যাতে ক্রেতাদেরকে ঠকিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করতে না পারে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসন মনিটরিং কববে বলেও জানান জেলা প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা।