মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ষোলটাকা ইউনিয়নের মানিকদিয়া গ্রামে মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে সাড়া জাগিয়েছেন কৃষক জহির। দীর্ঘ ২০ বছর মালয়েশিয়াতে থাকার পর দেশে ফিরে ছোট মুদীও দোকানের পাশাপাশি মালচিং পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে দাবি কৃষক জহিরের। জহির উপজেলার মানিকদিয়া মধ্যপাড়ার মফেজদ্দিনের ছেলে।
জানা যায়, সবজি চাষ করে জহিরের দেখানো মালচিং পদ্ধতির সফলতা দেখে আশপাশের চাষিরা আগ্রহী হচ্ছে। কিভাবে আরও স্মার্ট ও উন্নত পদ্ধতিতে সবজির চাষ করা যায় এনিয়ে যেন তার ভাবনার শেষ নেই। দেশী-বিদেশি বিভিন্ন উন্নতশীল বীজ সংগ্রহ করে এলাকায় মালচিং পদ্ধতিতে রোপণ করে সফলতা বেশ পেয়েছেন তিনি।
জহিরের সফলতা দেখে আগামীতে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের বেশ কিছু কৃষক মালচিং পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করবেন বলে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। চলতি মৌসুমে এ পদ্ধতিতে শসা, করোলা ও টমেটোসহ নানা প্রজাতীর সবজি চাষ করেছেন প্রবাস ফেরত কৃষক জহির।
অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে কৃষক জহির জানান তিনি প্রায় ২০ বছর মালয়েশিয়াতে গ্রীন হাউজ ও মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেছেন। মালচিং মূলত জাপান ও চীনের বিষমুক্ত সবজি চাষের একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে যখন গাছপালার গোড়া, সবজি ক্ষেত ও বাগানের বেডের জমি বিশেষ পদ্ধতিতে ঢেকে দেয়া হয় তখন তাকে বলে মালচ। আর এ পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতিটিকে মালচিং বলা হয়।
চাষে আধুনিকীকরণ ও বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার সাথে সাথে দিন দিন প্লাস্টিক মালচিং-এর ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এটি আধুনিক চাষাবাদের একটি উন্নত পদ্ধতি। এর ফলে ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া, ভাল ফলনের জন্য মাটি ঢেকে দিয়ে আবাদের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করা হয়। মাটির রস সংরক্ষণে এবং আগাছার প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে মালচিং পদ্ধতির ব্যবহার অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
এই পদ্ধতিতে প্রথমে পরিমাণমতো খাবার দিয়ে জমি প্রস্তুত শেষে সারি তৈরি করা হয়। সেই মাটির সারিগুলি পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর সারিগুলো দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে পলিথিন ফুটো করে সবজির চারা রোপণ করা হয়। চারা রোপণের পর থেকে শুধুমাত্র দেখভাল করা ছাড়া আর তেমন কোনও পরিচর্যা করতে হয় না। মাটির সারিগুলো পলিথিন দিয়ে ঢেকে থাকার কারণে বাইরে থেকে কোনও ছত্রাক কিংবা রোগবালাই সেই সবজির চারায় আক্রমণ করতে পারে না বলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় খুবই কম। এই পদ্ধতিতে চাষ করা টমেটোর গাছে ঢলে পড়া রোগ হয় না। ক্ষেতের পরিচর্যার জন্য তেমন শ্রমিকেরও প্রয়োজন হয় না বলে উৎপাদন খরচ খুবই কম হয়।
তাছাড়া মালচিং পদ্ধতিতে একবার জমি প্রস্তুত করলে তিনবার সবজি তৈরি সম্ভব হয়। ফলে প্রথমবার খরচটা কিছুটা বেশি হলেও পরের দুইবার সবজি তৈরিতে খরচ খুবই কম হয়। ফলে কৃষকরা বেশি লাভবান হয়। এছাড়াও এই পদ্ধতিতে ফলন দ্বিগুণ, সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় অনেক কৃষকরা এই পদ্ধতিতে সবজি চাষে ঝুঁকছেন।
প্রবাস ফেরত জহির মালয়েশিয়াতে কাজ করার সময় পরিকল্পনা করেছিলেন দেশে গিয়ে এই স্মার্ট ও মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করবেন। যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ দেশে ফিরে একটি মুদিখানা দোকান পরিচালনার পাশাপাশি এ মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন।
কৃষক জহির পরীক্ষামূলকভাবে মালচিং পদ্ধতিতে ১০ কাঠা জমিতে ২০ হাজার টাকা খরচ করে মাত্র ২ থেকে ৩ মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা আয় করেছেন। বর্তমানে দুই বিঘা জমিতে মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তিনি। করোলা, শসা ও টমেটো প্রজাতির সবজি চাষে প্রাথমিকভাবে তিনি ৬০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে সবজি বিক্রি করে প্রায় দুই লক্ষ টাকা আয় করেছেন। কৃষক জহিরের দাবি এই এলাকায় স্মার্ট ও আধুনিক কৃষি তিনিই প্রথম শুরু করেছেন।
তিনি আরো জানান সঠিক মালচিংয়ের ফলে পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। নিমাটোড বা ফসলে কৃমির আক্রমণ রোধ করে। প্রতিফলক মালচ পতঙ্গদের প্রতিহত করে। মালচিং পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণও রোধ করা যায়।
শীতকালে মালচ ব্যবহার করলে মাটিতে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব হয় এবং গরমকালে মাটি ঠান্ডা থাকে, এমনকি বেশ কিছু পোকামাকড়ের আক্রমণও রোধ করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা মালচিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সেচ লাগে অনেক কম। সেচের খরচ বাঁচে, লাভ হয় বেশি।
এই পদ্ধতি ব্যবহারে শিকড়ের কাছের স্থানে সার প্রয়োগ করার জন্য চাষে সার প্রয়োগের পরিমাণও অনেক কম লাগে। ফলে খরচের লম্বা তালিকা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্লাস্টিক শিট দিয়ে মাটি ঢেকে রাখার ফলে মাটির ঢাকা অংশের উষ্ণতা রাতে এবং শীতকালে পরিবেশের থেকে বেশি হয়। ফলে বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম দ্রুত সম্পন্ন হয়।
কৃষক জহিরের করোলা চাষে সফলতা দেখে স্থানীয় কৃষকরা মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আগামীতে গ্রীন হাউজ স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে তার।
তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে সকল মানুষ অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তারা বিদেশে না গিয়ে ওই টাকার কিছু অংশ থেকে জমি কন্টাক্ট নিয়ে মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করতে পারেন। এতে বিদেশের চাইতেও বেশি টাকা আয় করা সম্ভব। সেই সাথে প্রবাসের একাকীত্ব জীবনের গণ্ডি ছেড়ে পরিবার পরিজনের সাথে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবেন।
এছাড়া তিনি স্থানীয় কৃষকদের স্মার্ট ও আধুনিকভাবে কৃষিকাজ করার জন্য উৎসাহ দেন। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি মৌসুমে অনেক ভালো ফসল হবে মনে করেন তিনি। সবজিচাষি জহির জানান মালচিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্য গাংনী উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হয়। কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সবজি উৎপাদন করলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কষ্ট রয়ে গেছে তার মনে। দাম কিছুটা কম হলেও সবজি উৎপাদন থেকে তিনি পিছুপা হননি। এছাড়াও গাংনী উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার। সরকারিভাবে পদ্ধতিগত ও আর্থিক সহযোগিতা পেলে আরও ব্যাপক হারে সবজি চাষ করা সম্ভব বলে আশা করেন তিনি।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, মালচিং পদ্ধতি সবজি চাষের জন্য খুবই ভালো পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে খরচ সাশ্রয় হয় এবং কৃষক লাভবান হয়। এ পদ্ধতিতে একবার বেড প্রস্তুত করা হলে একই খরচে তিনবার সবজি তৈরি করা সম্ভব। শুধু ষোলটাকা ইউনিয়ন নয়, উপজেলার সকল ইউনিয়নে কৃষকদের আধুনিক ট্রেনিং দিয়ে সবজি চাষে উদ্ভুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়াও চলতি মৌসুম অনুযায়ী সময়ে সময়ে সরকারি প্রণোদনা কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেও কৃষকদেরকে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়।