মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের একই পরিবারের চার প্রতিবন্ধী সদস্য পেলেন জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নগদ টাকা, শীতবস্ত্র ও উপহার সামগ্রী।
শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে সদ্য বদলি হওয়া মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. আবদুল ছালাম ও তার পরিবারের সদস্যরা এই উপহার সামগ্রী প্রদান করেন।
তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদন দেখে প্রতিবন্ধী পরিবারের প্রতি তাদের মায়া হয়। সে কারণেই তিনি বিষয়টি আমলে নিয়ে পরিবারসহ ওই প্রতিবন্ধী পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা জাগে। সে কারণেই তিনি পরিবারের সদস্যরাসহ শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে কিছু নগদ টাকা, শীত বস্ত্র ও উপহার সামগ্রী নিয়ে পারিছা খাতুনের পরিবারে উপস্থিত হন।
উপহার সামগ্রী বিতরণ করে পরিবারের সকলের মাথায় হাত দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন, যেন পরিবারের সকলে ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন ও নিরাপদে থাকেন। সেই সাথে এলাকার সকলকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পরিবারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।
ভবানীপুর গ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারিছা খাতুনের একটি ছোট্ট ঘর যেখানে সূর্যের আলো ঢোকে ঠিকই, কিন্তু সেই আলো পৌঁছায় না পরিবারের কারও চোখে। তবুও জীবন থেমে নেই। চার প্রতিবন্ধী সদস্যের এই পরিবারে প্রতিদিনই চলতে থাকে টিকে থাকার এক কঠিন যুদ্ধ, যার নেতৃত্বে আছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পারিছা খাতুন।
পারিছা খাতুনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জন্ম থেকেই আলো-অন্ধকার সবকিছুই তাঁর কাছে একরঙা। কিন্তু মনের শক্তিকে তিনি কখনও হারতে দেননি। ২০১৪ সালের মার্চ মাসের ২৭ তারিখে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্বামী শাহিনকে সঙ্গী করে একটাই ভরসা পরিবারটাকে বাঁচিয়ে রাখা। নিজের চোখে দেখতে না পেলেও, দুই অন্ধ শিশু সন্তান পারভেজ (১১) ও হামিমের (৭) ভবিষ্যৎ আঁকতে তিনি চেষ্টা করেন প্রতিদিন।

চোখে আলো নেই, কিন্তু মনজুড়ে সীমাহীন দৃঢ়তা। হাতড়ে হাতড়ে চুলায় আগুন জ্বালানো, রান্না করা, সন্তানদের গোসল করানো, খাওয়ানো, পোশাক পরানো সবই করেন একা। অন্ধত্ব তাঁর কাছে বাধা নয়; বরং প্রতিদিনের সংগ্রামের সঙ্গী।
কিন্তু জীবন বড় কঠিন। স্বামী শাহিনের ক্ষুদ্র দিনমজুরির আয় আর আশপাশের মানুষের সহায়তায় কোনোমতে দিন চলে। অথচ এই পরিবারে চারজন প্রতিবন্ধী থাকা সত্ত্বেও সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পেয়েছেন মাত্র একজন। সন্তানদের সুস্থ চোখের স্বপ্ন দেখেছিলেন পারিছা খাতুন কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রেজাউল হকের কথায় পরিবারের অসহায় বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে: “অন্ধ পারিছা খাতুনের লড়াইটা আমরা কাছ থেকে দেখি। নিজের চোখে না দেখেও সন্তানদের আগলে রাখেন। আমরা যতটুকু পারি সাহায্য করি, কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়।”
একই গ্রামের আবেগভরা কণ্ঠে বলেন “এমন অসহায় পরিবারকে সাহায্য করা শুধু দায়িত্ব নয়, মানবতার দাবি।”
স্থানীয় চেয়ারম্যান আলম হোসেন জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের ইতিমধ্যেই দুইজনকে ভাতার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। “পরিবারটিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় এনে শতভাগ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। অন্ধ দুই শিশুর পড়াশোনার ব্যবস্থাও আমরা করছি।”
গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনও আশ্বাস দিয়েছেন— “দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পারিছা খাতুনের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে।”
অসহায়তার কালো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পারিছা খাতুন আজও বিশ্বাস করেন একদিন তাঁর দুই শিশু সন্তানও সমাজের আলো দেখতে পাবে, হয়তো চোখ দিয়ে নয়, কিন্তু জ্ঞান-শিক্ষা আর মানুষের ভালোবাসায়।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই— এই আলোহীন পরিবারের পাশে দাঁড়াবে কে?
উপহার সামগ্রী বিতরণের সময় গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার হোসেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের গোপনীয় শাখা, শিক্ষা ও কল্যাণ শাখা ও অভিযোগ নিষ্পত্তি সেল জিআরএস সহকারী কমিশনার ও বিজ্ঞ এক্সেকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট শেখ তৌহিদুল কবীর, পরিবারের সদস্যরা, স্থানীয় ইউপি সদস্য রেজাউল হকসহ স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।