স্বর্ণালী সঞ্চয় ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডের পরিচালক মাহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ভুক্তভোগী গ্রাহকদের। লগ্নিকৃত টাকা ফেরত না পেয়ে দিশেহারা গ্রাহকরা। লগ্নিকৃত টাকা ফেরত পেতে সমিতির কর্মীদের দ্বারে-দ্বারে ঘুরেও কোন কূলকিনারা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। ঘটনাটি ঘটেছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামে। সমিতির পরিচালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ টাকা ফেরতের দাবি ভুক্তভোগী গ্রাহকদের। মাহিরুল ইসলাম উপজেলার পুরাতন মটমুড়া গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে।
মাহিরুল ইসলাম ২০১৩ সালে কাথুলী ইউনিয়নের গাড়াবাড়িয়া বাজারে স্বর্ণালী সঞ্চয় ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংস্থা চালু করে। সংস্থাটি সংশয় আদায়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠন ও সদস্যদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, সমিতির সদস্যদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, ফসলী ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সহ সার্বিক উন্নয়ন ও সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার প্রত্যয় নিয়ে ২০১৩ সালে সমবায় অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করে। যার নম্বর-০৩/মেহের, তারিখঃ০৮/১০/২০১৩।
লগ্নিকৃত এক লাখ টাকায় প্রতিমাসে ১ হাজার ৬শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা লাভ দেয়া হয় এমন প্রলোভন ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষের স্বপ্নকে পুঁজি করেছিল মতলববাজ এই সংস্থাটি। সমিতির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের বিশ্বস্থতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে নিম্নআয়ের কিছু মানুষ সমিতির প্রলোভনে ও বাড়তি আয়ের আশায় সহায় সম্বল বিক্রি করে টাকা জমা করে স্বর্ণালী সংস্থায়। মাসিক কিংবা বাৎসরিক কিস্তিতে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে আট লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত রেখেছে সদস্যরা।
সমিতির প্রতি বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য প্রথমদিকে সংস্থাটি লাভ প্রদান করলেও ১ লা ফেব্রুয়ারী তারিখে অফিসে তালা লাগিয়ে উধাও হয়ে যায় সংস্থাটির পরিচালক মাহিরুল ইসলাম। বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে গ্রাহকরা। এ এলাকার অন্তত দুই শতাধিক নারী-পুরুষের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে সমিতির পরিচালক। সমিতির সদস্যরা এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে মানববন্ধন করেছে।
গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাজা বাদাম ও ছোলা বিক্রেতা বায়েজিদ হোসেন জানান, সংস্থাটির প্রলোভনে তিনি দুই মাস আগে বন্ধকী জমির টাকা ফেরত নিয়ে চার লাখ টাকা জমা রেখেছেন। লাভের মুখ না দেখতেই সমস্ত টাকা নিয়ে পরিচালক মাহিরুল ইসলাম লাপাত্তা বিষয়টি বুঝতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি টাকা ফেরতসহ ও মাহিরুল ইসলামের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। একই কথা জানিয়েছেন গাড়াবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল কারিকরের ছেলে অসুস্থ রবিউল ইসলাম। তিনি জমা রেখেছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। শুধু বাইজিদ কিংবা রবিউল ইসলাম নয়, সংস্থাটিতে লক্ষ লক্ষ টাকা জমা রেখেছে গাড়াবাড়িয়া গ্রামের জিল্লুর রহমান, সবুর, ফিরোজ, বাবলু, দুলু, খালেক, হাফেজ, জহির উদ্দিন, ময়নাসহ কাথুলী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শত শত মানুষ।
সংস্থাটির পরিচালক মাহিরুল ইসলাম কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বর্তমানে পলাতক। সংস্থাটিতে ৬ জন স্থানীয় ব্যক্তি কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারা হলেন- গাড়াবাড়িয়া গ্রামের আসাদুল হকের ছেলে বিল্লাল হোসেন, তার সহোদর বাইজিদ হোসেন, দাউদ হোসেনের ছেলে শাহারুল ইসলাম, আজিম উদ্দিনের ছেলে আলমগীর হোসেন ও রাধাগোবিন্দপুর ধলা গ্রামের রাজু আহমেদ। তারা কর্মী হিসেবে কাজ করলেও ভুক্তভোগী সদস্যদের জামানতের টাকার দায় নিচ্ছে না কেউ।
সংস্থাটির কর্মী গাড়াবাড়িয়া গ্রামের দাউদ হোসেনের ছেলে শাহারুল ইসলাম জানান পরিচালক কার কাছ থেকে জামানত নিয়েছে সে বিষয়টিই আমার জানা নেই। আমি সেখানে চাকরি করেছি মাত্র। আমারও সংস্থার কাছে ৩০ হাজার টাকা জামানত রেখে চাকুরীতে ঢুকে ছিলাম। সংস্থাটির কাছে জামানতের টাকাসহ দুই মাসের বেতন পাওনা রয়েছে। তবে মুখ খুলতে রাজি হননি কর্মী বিল্লাল হোসেন।
গাড়াবাড়িয়া ক্যাম্পপাড়ার নেতৃস্থানীয় মরহুম আব্দুল খালেকের ছেলে রশিদুল ইসলাম জানান, নয় দশ বছর আগে গাড়াবাড়িয়া বাজারের অদূরে আলাউদ্দিন চৌকিদারের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সংস্থার কার্যক্রম শুরু করে মাহিরুল ইসলাম। কাথুলী বিজিবি ক্যাম্পের সামনে আড়াই কাঠা জমি কিনে দ্বিতল ভবন তৈরি করেছেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে মাহিরুল ইসলামের লাপাত্তার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা। তারপর থেকে দ্বিতল ভবনে তালা লাগিয়ে বাড়ির সকলেই অন্য কোথাও অবস্থান করছেন।
কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান রানা জানান, পহেলা ফেব্রুয়ারী থেকে সমিতির সভাপতি মাহিরুল ইসলাম লাপাত্তা হওয়ার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে। ভুক্তভোগীদের আমানতের টাকা ফেরত পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি। আমানতের টাকা ফেরত পেতে গ্রহীতাদের আইনগত সহযোগিতা পেতে সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেন তিনি।
গাংনী উপজেলা সমবায় অফিসার মাহবুবুল হক মন্টু বলেন, গ্রাহকদের টাকা নিয়ে একটি সমবায় সমিতি পালিয়ে গেছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে সরেজমিনে গিয়ে তাদের কাউকে অফিসে পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যেই সমিতির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। অফিসের নথি অনুযায়ী স্বর্ণালী সমিতিতে ১১৮ জন সদস্য। তবে আমানত যাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে তাদেরকে সদস্য হিসেবে কোন তথ্য সমবায় অফিসে প্রদান করেন নাই সমিতির সভাপতি মাহিরুল ইসলাম। আমানত গ্রহীতাদেরকে যেহেতু সদস্য হিসেবে দেখানো নেই বিধায় তিনি ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কৌশলে এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সমবায় আইনে কোন সমবায় সমিতি এফডিআর করতে পারে না। গ্রাহকেরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। ঘটনা তদন্ত করে মাহিরুল ইসলাম দোষী প্রমাণিত হলে সদস্যদের আইনগত ব্যবস্থা নিতে সহযোগিতা করা হবে।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী খানম জানান, স্বর্ণালী সমবায় সমিতির পরিচালক ভুক্তভোগীরা টাকা আত্মসাতের বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। উপজেলা সমবায় অফিসারকে বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার সাথে কথা বলে অগ্রগতির বিষয়ে জানা গেছে, যাদের কাছে আমানত নেওয়া হয়েছে তাদেরকে সমবায় সমিতির সদস্য হিসেবে দেখানো নাই। অর্থাৎ তিনি ব্যক্তিগত যোগাযোগে লোভ দেখিয়ে টাকা গ্রহণ করেছেন। ভুক্তভোগীরা যেহেতু সমবায় সমিতির সদস্য না বিধায় সমবায় অফিসের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব না। তবে মানবিক দিক বিবেচনা করে ভুক্তভোগীদের আইনগত সহায়তা পেতে সহযোগিতা করা হবে।